শবে কদরের ফজিলত ও আমলের নিয়ম।
শবে কদরের ফজিলত ও আমলের নিয়ম। |
শবে কদদের নামাজের
নিয়ম।
শবে কদরে নফল
নামাজ পড়া উত্তম ইবাদাত। নফল নামাজ সম্পর্কে তাফসিরে রুহুল বয়ানে উল্লেখ আছে, হযরত
ইসমাইল হাক্কী (র) বলেছেন: বুজুর্গানে দ্বীনগন দশদিনের বেজোর রাতগুলোতে শবে কদরের নিয়তে
নফল নামাজ পড়তেন।
প্রসিদ্ধ ফকিহ
আবুল লাইস সমরকন্দী (র) বলেন: শবে কদরের নামাজের প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা
কদর ও তিনবার সূরা এখলাস পড়া উত্তম। প্রত্যেক দুই রাকাতের পর সালাম ফিরিয়ে দরুদ শরীফ
পাঠ করা তারপর দুই রাকাত করে যে যত নিয়ত করবে তত রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নওয়া। ( তাফসিরে রুহুল বয়ান, ১০ খন্ড, ৪৮৩ পাতা।)
তবে প্রসিদ্ধমত
হচ্ছে এশার নামাজের পর দুই রাকাত করে ১২ রাকাত নফল নামাজ পড়া । নফল নামাজ এশার নাশার
নামাজের পর আদায় করা যাবে।
শবে কদর সম্পর্কিত সহিহ হাদিস।
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (প্রতি) মাসের মধ্যবর্তী দশ দিন ই’তিকাফ করতেন। যখন বিংশতিতম রাত অতিবাহিত হওয়ার এবং একবিংশতিতম রাতের আগমনের সময় হত তিনি তাঁর ঘরে ফিরে আসতেন এবং তাঁর সঙ্গে যারা ই’তিকাফ করতেন তারাও ফিরে আসতেন। তারপর তিনি অন্য এক সাথে, যে মাসে ই’তিকাফ করেছিলেন ঐ রাতেও রয়ে গেলেন যে রাতে তিনি ঘরে ফিরে আসতেন এবং লোকদের সামনে খুতবা দিলেন। তাঁদেরকে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী আদেশ করলেন। তারপর বললেন, আমি এই মধ্যবর্তী দশদিন ই’তিকাফ করতাম, পরে আমার কাছে প্রকাশ পেল যে, আমি এই শেষ দশ দিনেও ই’তিকাফ করি, অতএব জারা আমার সাথে গত মধ্যবর্তী দশদিন ই’তিকাফ করেছ তাঁরা স্বীয় ই’তিকাফের স্থানে স্থির থাকবে। আমি এই শবে কদরকে স্বপ্নে দেখেছিলাম কিন্তু আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে, অতএব তোমরা তা এই শেষ দশ রাতে প্রত্যেক বেজোড় রাতে তালাশ করো। স্বপ্নে আমাকে দেখলাম যে, আমি পানি এবং কাদার মধ্যে সিজদা করছি। আবূ সাঈদ (রাঃ)বলেন, আমাদের উপর একবিংশতিতম রাতে বৃষ্টি হল, বৃষ্টির পানি মসজিদে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সালাত আদায় করার জায়গার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেল। আমি তাঁর দিকে লক্ষ্য করলাম যে, তিনি ফজরের সালাত থেকে সালাম ফিরিয়ে নিয়েছেন, আর তাঁর চেহারা পানি ও কাদা দ্বারা আপ্লুত ছিল।
সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ১৩৫৬
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেনঃ যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকির আশায় কদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত্রি জাগবে, তার পূর্বের গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হবে।
(৩৭, ৩৮, ১৯০১, ২০০৮, ২০০৯, ২০১৪; মুসলিম ২/২৫ হাঃ ৭৬০) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৪, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৩৪)
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৫
‘উবাদাহ ইব্নু সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লায়লাতুল কদ্র সম্পর্কে জানানোর জন্য বের হলেন। তখন দু’জন মুসলমান বিবাদ করছিল। তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের লাইলাতুল কদ্র সম্পর্কে জানানোর জন্য বেরিয়েছিলাম; কিন্তু তখন অমুক অমুক বিবাদে লিপ্ত থাকায় তা (লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কিত জ্ঞান) উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আর হয়তো বা এটাই তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। তোমরা তা অনুসন্ধান কর (রমযানের) ২৭, ২৯ ও ২৫ তম রাতে।
(২০২৩, ৬০৪৯) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৭, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৪৭)
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪৯
ইব্নু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
সাহাবীগণ আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট (তাঁদের দেখা ) স্বপ্নের বর্ণনা দিলেন। লাইলাতুল কদর রমযানের শেষ দশকের সপ্তম রাতে। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমি মনে করি যে, ( লাইলাতুল কদর শেষ দশকে হবার ব্যাপারে ) তোমাদের স্বপ্নগুলোর মধ্যে পরস্পর মিল রয়েছে। কাজেই যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদ্রের অনুসন্ধান করতে চায় সে যেন তা শেয দশকে অনুসন্ধান করে।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১১৫৮
ইব্নু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর কতিপয় সাহাবীকে স্বপ্নের মাধ্যমে রমযানের শেষের সাত রাত্রে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়। (এ শুনে) আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমাকেও তোমাদের স্বপ্নের অনুরূপ দেখানো হয়েছে। (তোমাদের দেখা ও আমার দেখা) শেষ সাত দিনের ক্ষেত্রে মিলে গেছে। অতএব যে ব্যক্তি এর সন্ধান প্রত্যাশী, সে যেন শেষ সাত রাতে সন্ধান করে।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২০১৫
‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেনঃ তোমরা রমযানের শেষ দশকে [৩] লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর।
ফুটনোটঃ
[৩] আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমের সূরা ক্বদরে ঘোষণা করেছেন- লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের (ইবাদাতের) চেয়েও উত্তম। সহীহ শুদ্ধ হাদীস থেকে জানা যায় যে, লাইলাতুল ক্বদর রমযানের শেষ দশ দিনের যে কোন বিজোড় রাত্রিতে হয়ে থাকে। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখে লাইলাতুল ক্বদর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখিত আছে। হাদীসে এ কথাও উল্লেখিত আছে, যে কোন একটি নির্দিষ্ট বিজোড় রাত্রিতেই তা হয় না। (অর্থাৎ কোন বছরে ২৫ তারিখে হল, আবার কোন বছরে ২১ তারিখে হল এভাবে। আমাদের দেশে সরকারী আর বেসরকারীভাবে জাঁকজমকের সঙ্গে ২৭ তারিখের রাত্রিকে লাইলাতুল ক্বদরের রাত হিসেবে পালন করা হয়। এভাবে মাত্র একটি রাত্রিকে লাইলাতুল ক্বদর সাব্যস্ত করার কোনই হাদীস নাই। লাইলাতুল ক্বদরের সওয়াব পেতে চাইলে ৫টি বিজোড় রাত্রেই তালাশ করতে হবে।
বর্তমানে রাত্রি জাগরণের জন্য মসজিদে সকলে সমবেত হয়ে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলের যে ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে সেটিও নবাবিষ্কৃত কাজ। কারণ আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সময়ে সাহাবীদের নিয়ে মসজিদে জাগরিত হয়ে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে ইবাদত না করে নিজ নিজ পরিবারকে জাগিয়ে কিয়ামুল লাইল পালন করতেন।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২০২০
আবূ সা’ঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, আমরা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর সঙ্গে রমযানের মধ্যম দশকে ই’তিকাফ করি। তিনি বিশ তারিখের সকালে বের হয়ে আমাদেরকে সম্বোধন করে বললেনঃ আমাকে লাইলাতুল কদর (-এর সঠিক তারিখ) দেখানো হয়েছিল পরে আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান কর। আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ঐ রাতে) কাদা-পানিতে সিজদা করছি। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - এর সঙ্গে ই’তিকাফ করেছে সে যেন ফিরে আসে (মসজিদ হতে বের হয়ে না যায়)। আমরা সকলে ফিরে আসলাম (থেকে গেলাম)। আমরা আকাশে হাল্কা মেঘ খন্ডও দেখতে পাইনি। পরে মেঘ দেখা দিল ও এমন জোরে বৃষ্টি হলো যে, খেজুরের শাখায় তৈরী মসজিদের ছাদ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল। সালাত শুরু করা হলে আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) - কে কাদা-পানিতে সিজদা করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে আমি কাদার চিহ্ন দেখতে পাই।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২০১৬
‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, তোমরা (লাইলাতুল কদর) অনুসন্ধান কর।
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২০১৯
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি আল্লাহ তা’আলার উপর দূঢ় বিশ্বাস রেখে সওয়াবের নিয়তে তারাবীহ্র সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করে, তার পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রেখে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত্রে জাগ্রত থাকে, তার পূর্বাপৃর সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।
সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ২২০৬
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় রমাযান (রমজান) মাসে সিয়াম পালন করবে, তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় ‘ইবাদাতে রাত কাটাবে, তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় লায়লাতুল কদরে ‘ইবাদাতে কাটাবে তারও আগের সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারী, মুসলিম)[১]
ফুটনোটঃ
[১] সহীহ : বুখারী ৩৮, ১৮০২, ১৯১০, ২০১৪, মুসলিম ৭৬০, আবূ দাঊদ ১৩৭২, নাসায়ী ২২০৫, ইবনু মাজাহ ১৬৪১, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৮৭৫, আহমাদ ৭১৭০, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ১৮৯৪, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৫০৬, সহীহ ইবনু হিববান ৩৪৩২।
মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ১৯৫৮।
যির ইবনু হুবায়শ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, আমি উবাই ইবনু কা‘বকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার (দীনী) ভাই ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ বলেন, যে ব্যক্তি গোটা বছর ‘ইবাদাত করার জন্য রাত জাগরণ করবে, সে ‘কদর রজনী’ পাবে। উবাই ইবনু কা‘ব বললেন, আল্লাহ তা‘আলা ইবনু মাস‘ঊদ এর ওপর রহম করুন। তিনি এ কথাটা এজন্য বলেছেন, যেন মানুষ ভরসা করে বসে না থাকে। নতুবা তিনি তো জানেন যে, ‘কদর’ রমাযান (রমজান) মাসেই আসে। আর রমাযান (রমজান) মাসের শেষ দশ দিনের এক রাতে কদর রজনী হয়। সে রাতটা সাতাশতম রাত। এদিকে উবাই ইবনু কা‘ব কসম করেছেন এবং ‘ইনশা-আল্ল-হ’ বলা ছাড়াই বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে কদর রাত (রমাযানের) সাতাশতম রাত’। আমি আরয করলাম, হে আবূল মুনযির (উবাই-এর ডাক নাম)! কিসের ভিত্তিতে আপনি এ কথা বলেছেন? তিনি বললেন, ঐ আলামাত ও আয়াতের ভিত্তিতে, যা আমাদেরকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। (তিনি বলেছেন), ঐ রাতের সকালে সূর্য উদয় হবে, কিন্তু এতে কিরণ বা আলো থাকবে না। (মুসলিম)[১]
ফুটনোটঃ
[১] সহীহ : মুসলিম ৭৬২।
মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ২০৮৮।